মা তোমার জন্যই আমি আজ "মানুষ"
মা তোমার জন্যই আমি আজ "মানুষ"
১. সেই শীতের সকাল
রফিকের মনে এখনো স্পষ্ট সেই সকালে দেখা মায়ের মুখটা। চারপাশে কুয়াশা, বাতাসে ছিল হিমেল স্পর্শ। কিন্তু তার গায়ে তখনো ছিল না কোনো সোয়েটার। মা নিজের গায়ের চাদরটা খুলে ছেলেকে পেঁচিয়ে রেখেছিলেন।
মা বলেছিলেন,
"তোর ঠান্ডা লাগবে বাবা, আমার কিচ্ছু হবে না।"
রফিক তখন ছিল ক্লাস থ্রির ছাত্র। সেদিন বুঝতে পারেনি, এটা একটা ছোট্ট চাদরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশাল ভালোবাসার গল্প।
২. মাটির ঘরে বড় হওয়া এক রাজপুত্র
রফিকের বাবা মারা যান রফিক যখন মাত্র ৪ বছর। গ্রামে তাদের ছিল একটি ছোট মাটির ঘর। মা রাবেয়া বেগম জীবনের সকল ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি কারো কাছে হাত পাতেননি, কারো করুণাও চাননি।
দুপুরে বাড়ির পাশের খালে মাছ ধরে বিকেলে বাজারে বিক্রি করতেন। আবার মাঝে মাঝে গাছ থেকে তেঁতুল পেড়ে বাজারে বেচতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রফিককে পড়াতে বসতেন। মুখে তার চিরচেনা হাসি, অথচ ভিতরে চলত এক দুঃসহ সংগ্রাম।
৩. স্কুলে ছেলের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রফিকের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। রফিক ভেবেছিল, এবার হয়তো স্কুলে যেতে পারবে না। কারণ নতুন জুতা কেনার টাকা তো নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় মা বললেন,
"কালকে তুই স্কুলে যাবি নতুন স্যান্ডেল পায়ে।"রফিক বিশ্বাস করেনি, কিন্তু পরদিন সকালে উঠেই দেখল দরজার পাশে একটি নতুন স্যান্ডেল।
অনেক বছর পর রফিক জানতে পারে, মা নিজের একটা সোনার নাকফুল বন্ধক দিয়ে সেই স্যান্ডেল কিনেছিলেন।
৪. উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার যুদ্ধ
এসএসসি পাস করার পর কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় হলো। ভর্তি ফি, বই, খাতা—সব মিলিয়ে অনেক টাকা দরকার।
রাবেয়া বেগম গ্রামে মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে কাজ করতেন। বউরা তাকে অপমান করে বলত,
"তোর ছেলে আবার কী পড়ে! কাজে লাগাতিস, সংসারটা সামলাতিস।"
কিন্তু মা কখনো হার মানেননি। দিনের পর দিন উপোস করে টাকা জমিয়ে রফিককে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন।
৫. মা যখন অসুস্থ, ছেলেকে বলেনি কিছুই
রফিক এখন শহরে পড়ে। মা আগের মতো প্রতিদিন ফোন করেন না। হঠাৎ একদিন গ্রামের এক আত্মীয় ফোন করে জানায়,
"তোর মা তিন দিন ধরে জ্বর নিয়ে বিছানায়। ডাক্তার দেখানো হয়নি।"
রফিক ছুটে যায়। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। জানতে পারে—মা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু ছেলেকে কষ্ট দেবে বলে কিছু বলেননি।
রফিকের চোখের জল থামছিল না। বলেছিল,
"মা, কষ্ট পেলে বলবি না কেন?"
মা কেবল বলেছিল,
"তুই তো দূরে থাকিস বাবা, তোর পড়া নষ্ট হোক তা চাইনি।"
৬. নিজের স্বপ্ন বিসর্জন, ছেলের ভবিষ্যতের জন্য
ছোটবেলায় রাবেয়া বেগমের স্বপ্ন ছিল—তিনি একদিন স্কুলে পড়াবেন। কিন্তু বিয়ে, সংসার আর স্বামীর মৃত্যু সেই স্বপ্ন ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করেছে।
কিন্তু তিনি সেই স্বপ্ন নিজের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন, রফিকের চোখে।
"তুই আমার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাবা, তুই শিক্ষক হবি" — বারবার বলতেন।
রফিক তাই সব কষ্ট পেছনে রেখে নিজের পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। শিক্ষকতাই বেছে নিয়েছিল পেশা হিসেবে। আজ সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।
৭. মায়ের শেষ চিঠি
মা মারা যান রফিকের চাকরির প্রথম বছরেই। হঠাৎ এক সকালে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন।
মায়ের ঘর গুছাতে গিয়ে রফিক পায় একটি চিঠি। হলুদ হয়ে যাওয়া সেই কাগজে লেখা:
"বাবা, আমি জানি তুই একদিন অনেক বড় হবি। তোর কষ্ট যেন আমি নেই নিতে পারি—এই দোয়া করি রোজ। যদি আমি থাকি না, তবুও মনে রাখিস, তোর জন্য আমি সব ছেড়েছিলাম। শুধু চাই, তুই ভালো থাকিস। ভালো মানুষ হ।"
রফিক সেই চিঠি হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদে। কাঁদে এক ছেলে, যে আজ মানুষ হয়েছে, কিন্তু যার মা আর নেই সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য।
৮. ভালোবাসার চিহ্নগুলো এখনো আছে
আজ রফিক নিজেই একজন বাবা। প্রতিদিন ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যায়, পড়া শেখায়। কিন্তু মাঝে মাঝে থমকে যায়। মা’র কথা মনে পড়ে।
তখন ছেলের মুখে হাত রেখে বলে—
"তোর দাদির মতো মা আর কখনো হবে না। মা শুধু ভালোবাসে না, নিজের জীবন দিয়ে গড়ে তোলে ভবিষ্যৎ।"
উপসংহার
একজন মা শুধু জন্ম দেন না—তিনি গড়ে তোলেন। নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের স্বপ্ন সত্যি করেন। তাঁর আত্মত্যাগ, তাঁর নিঃশব্দ কষ্ট, তাঁর বিনা স্বার্থের ভালোবাসা—এসবই তাঁকে "মা" করে তোলে।
আজকের সমাজে যখন সন্তান মা-বাবার অবহেলায় ব্যস্ত, তখন রাবেয়া বেগমের মতো হাজারো মায়ের গল্প মনে করিয়ে দেয়—"মা" শব্দটার মানে কত গভীর।
তুমি যদি এই গল্পে মায়ের ভালোবাসা অনুভব করে থাকো, তাহলে এই গল্পটা একবার হলেও শেয়ার করো। কারণ এমন হাজারো মা এখনো লড়াই করছেন কোনো গল্প ছাড়াই…
No comments